২০ এপ্রিল ২০২৪, ০২:০৬ অপরাহ্ন, ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি, শনিবার, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নোটিশ
জরুরী ভিত্তিতে কিছুসংখ্যক জেলা-উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হবে যোগাযোগ- ০১৭১২৫৭৩৯৭৮
করোনা: ৯ দিনের অক্সিজেন বিল সাড়ে ৩ লাখ! আজকের ক্রাইম-নিউজ

করোনা: ৯ দিনের অক্সিজেন বিল সাড়ে ৩ লাখ! আজকের ক্রাইম-নিউজ

অনলাইন ডেস্ক:: মাত্র ৩০ মিনিট অক্সিজেন দিয়ে ৯ দিনের অক্সিজেন বিল নিয়েছে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল।রাজধানীর কল্যাণপুরে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করাতে সাড়ে চার হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। রাজধানীর পান্থপথের বড় একটি হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয় পাঁচ হাজার টাকা।
আরো কয়েকটিতে নেওয়া হচ্ছে সাড়ে চার হাজার টাকা করে। অথছ সরকার পরীক্ষার জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে।

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে সরকার পরীক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে অনুমতি দেয়নি। সে কারণে তখন বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল বাণিজ্যের সুযোগ আদায়ের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে নানা অজুহাতে সব ধরনের চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেক হাসপাতাল বন্ধ রাখা হয়েছিল।

পরে সরকার বাধ্য হয়ে কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে করোনা চিকিৎসা করাতে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এখন সব হাসপাতালকেই করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এর পরই হাসপাতালগুলো চিকিৎসার নামে শুরু করেছে বাণিজ্য।

এই সব কিছুই ছাড়িয়ে যায় ভয়াবহ ঘটনাটি:

নারায়ণগঞ্জের ভুঁইঘরের বাসিন্দা আক্তার হোসেন (৪৮) শ্বাসকষ্টসহ ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে তাঁকে শহরের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়।

তবে ভর্তি নিতে রাজি হয়নি নারায়ণগঞ্জের কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র। বাধ্য হয়ে গতকাল সকালে তাঁকে রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঘণ্টাখানেক অ্যাম্বুল্যান্সে অপেক্ষা করলেও সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীরা সাড়া দিচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে ছটফট করতে করতে অ্যাম্বুল্যান্সের ভেতরেই প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁকে। যা ধরা পড়েছে এক সাংবাদিকের ক্যামেরায়।

৩০ মিনিটে ৯ দিনের অক্সিজেন বিল

সরকারের সঙ্গে চুক্তি করা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর একটি রাজধানীর ধানমণ্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল। সেখানে মাত্র ৩০ মিনিট অক্সিজেন দিয়ে ৯ দিনের অক্সিজেন বিল নিয়েছে মোজাম্মেল হক চৌধুরী নামের এক রোগীর কাছ থেকে। রাজধানীর এই বাসিন্দা গত ৩০ মে ভর্তি হয়েছিলেন ওই হাসপাতালে। তিনি ১৫ দিন চিকিৎসা নিয়েছেন।

বিল করা হয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। নার্স, কর্তব্যরত চিকিৎসক কেউ তাঁর কাছে না গেলেও বিলে তাঁদের ফিও ধরা হয়েছে। মোজাম্মেল হক বলছিলেন, তিনি নিজে কক্ষ পরিষ্কার করলেও সেই বাবদ রাখা হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে হাসপাতালটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিষয়টা আমরা শুনেছি। কিন্তু রোগী বা তাঁর স্বজনরা অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে আসেননি।

এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, অতিরিক্ত বিল নিলে সুষ্ঠু সমাধান দেওয়া হবে।’ এর আগেও এমন একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা টাকা ফেরত দিয়েছেন বলে তিনি জানান।

শুধু ঢাকায় নয়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া হাসপাতালগুলো নিজেদের প্রয়োজনে করোনা রোগীকে নন-করোনা আর নন-করোনা রোগীকে করোনা বানানোর অভিযোগও রয়েছে। পরীক্ষার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি নেওয়া হচ্ছে।

শাস্তি নেই!

এসব ঘটনা বন্ধে বা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না।

বেসরকারি হাসপাতালের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছেন, এমন একাধিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর রোগী নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ পুরনো।

করোনাভাইরাস মহামারি দেখা দেওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছিল তাদের পরীক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ দিলে এমন বাণিজ্যের ‘উৎসব’ শুরু হবে, যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে সে কারণেই শুরুর দিকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা ও এই ভাইরাসজনিত রোগ কভিড-১৯-এর চিকিৎসার অনুমতি দিতে দেরি করা হচ্ছিল।

বিভিন্ন হাসপাতাল, ভুক্তভোগী রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার পরীক্ষার জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করে দিলেও কোনো কোনো হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আদায় করছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।

সরকারের শর্ত অনুযায়ী, রোগী প্রতিষ্ঠানে এসে নমুনা দিলে সাড়ে তিন হাজার টাকার বেশি রাখা যাবে না। আর বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করলে এক হাজার টাকা বাড়তি নেওয়া যাবে।

আগে চিকিৎসক দেখানো বাধ্যতামূলক!

রাজধানীর পান্থপথের বড় একটি হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয় পাঁচ হাজার টাকা। আরো কয়েকটিতে নেওয়া হচ্ছে সাড়ে চার হাজার টাকা করে। কৌশল হিসেবে কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতাল সরাসরি পরীক্ষা না করে আগে রোগীকে চিকিৎসক দেখানো বাধ্যতামূলক করে রেখেছে।

চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে লিখলেই শুধু পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু চিকিৎসক শুধু করোনা পরীক্ষায় নয়, সিটি স্ক্যান, এক্স-রেসহ আরো অনেক ধরনের পরীক্ষা লিখে দেন; যা ওই হাসপাতালেই করাতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, সেই ধরনের পরীক্ষা ব্যবস্থাপত্রে লেখা হচ্ছে যেগুলো করাতে টাকা বেশি লাগে।

কারণ আমরা নিজেরা পরীক্ষা করি না!

রাজধানীর কল্যাণপুরে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করাতে সাড়ে চার হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। ওই হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা নিজেরা পরীক্ষা করি না। অন্য জায়গা থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনতে হয়। তাদের সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে হয়।

এ ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহ কিট ও টিউব আমাদের দিতে হয়। নমুনা সংগ্রহ করে আমাদের কর্মীরা। এসব খরচ বাবদ বাড়তি এক হাজার টাকা নেওয়া হয়।’

এই হাসপাতালসহ আরো কয়েকটি হাসপাতালে করোনার জটিল রোগীদের জন্য ব্যবহার করা রেমডিসিভির ইঞ্জেকশনের দাম ক্ষেত্রবিশেষ ছয়-সাত হাজার টাকা নেওয়া হয় বলে কোনো কোনো রোগীর স্বজনরা জানিয়েছেন।

অথচ এই ইঞ্জেকশনের দাম সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। অবশ্য বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ওই কর্মকর্তা এই ওষুধের দাম বেশি নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কম্পানি নির্ধারিত এমআরপি (সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য) নিই। এর বেশি নেওয়া হয় না।’

আইসিইউ বাণিজ্য

বেসরকারি হাসপাতালের সেবার মান নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) কতটা মানসম্পন্ন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে খোদ চিকিৎসকদের মধ্যেই।

বিশেষ করে কয়েকটি বড় বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জের মৃত্যুর ঘটনায় এই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এসব হাসপাতালের আইসিইউ যথেষ্ট নিরাপদ বা মানসম্পন্ন কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার বলেও কেউ কেউ মনে করছেন।

আইসিইউ নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগও বেড়েছে। আইসিইউয়ের জন্য এখনো রোগীদের ঘুরতে হচ্ছে হন্যে হয়ে। সরকারি হাসপাতালে রোগীদের ভিড় বেশি থাকায় অনেকেই বেশি টাকা দিয়ে হলেও আইসিইউ পেতে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটে যায়। এই সুযোগে আইসিইউয়ের ভাড়া কোনো কোনো হাসপাতালে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে এখন সব মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। এর অর্ধেকের বেশি ঢাকায়। এর মধ্যে মোট আইসিইউ বেড রয়েছে ৭৩৭টি। এর মধ্যে ঢাকায় ৪৯৪টি ও ঢাকার বাইরে ২৪৩টি।

চিকিৎসক নিজেই অন্য হাসপাতালে!

অনেক চিকিৎসক নিজের হাসপাতাল রেখে অন্য হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রশ্ন উঠেছে, আক্রান্ত চিকিৎসক যে হাসপাতালে চাকরি করেন বা করতেন সেই হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা ভালো না হওয়ায় তাঁরা অন্য হাসপাতালে ছুটছেন কি না? মারা যাওয়া কয়েকজন চিকিৎসকও নিজের হাসপাতাল রেখে অন্য হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।

সর্বশেষ গত বুধবার রাজধানীর আল মানার হাসপাতালের একজন চিকিৎসক মারা যান অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।

বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালেই নেই পর্যাপ্ত ও দক্ষ জনবল। সাধারণত সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা এসব হাসপাতালে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে তাঁরা অনেকেই এখন বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

এটাই স্বাভাবিক!

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে কেউ বেশি টাকা নিয়ে থাকলে সেটা অন্যায় হচ্ছে। তবে একটি বিষয় সবাইকে জানা দরকার, যেসব বেসরকারি হাসপাতাল এখন কভিড রোগীর সেবা দিচ্ছে সেই হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে খরচ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের বেতন কমপক্ষে দ্বিগুণ করতে হয়েছে।

ফলে সার্ভিস থেকে শুরু করে অন্যান্য খরচ আগের খরচের সঙ্গে তুলনা করলে বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে আমরা তাদের মটিভেশন দেওয়ার চেষ্টা করছি তারা যাতে সেবা বন্ধ না করে দেয় এবং মানুষকে হয়রানি না করে সে জন্য।’ চিকিৎসক দিতে গিয়ে চিকিৎসকদের মৃত্যুর বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি অবশ্যই প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে যারা করোনা রোগীর সেবা দিচ্ছেন তাদেরকে স্যালুট জানাতে চাই।’

মাঝেমধ্যেই এমন কিছু অভিযোগ আসে

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কাছে মাঝেমধ্যেই এমন কিছু অভিযোগ আসে। ইতিমধ্যেই আমরা অনেক হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া অতিরিক্ত বিল ফেরত দিতে বাধ্য করেছি। ওই সব হাসপাতালকে সতর্ক করে দিয়েছি। এখন আমরা আরো কঠোর অবস্থানে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি।

ইতিমধ্যে আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কথাও বলেছি, স্বাভাবিক সময়ে যেমন অভিযান হতো সে ধরনের অভিযান পরিচালনার জন্য।’ তাঁর পরামর্শ, যাঁরা হয়রানি হচ্ছেন কিংবা অভিযোগ জানাতে চান তাঁরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে হাসপাতাল শাখায় অভিযোগ করুন। তাঁরা সে অনুসারে ব্যবস্থা নেবেন।

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © 2019