২০ Jun ২০২৫, ০৪:৩২ অপরাহ্ন, ২৩শে জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি, শুক্রবার, ৬ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, সুন্দরবন থেকে ফিরে: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্ব ঐতিহ্য বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের উপকূলের জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় দেশের সবচেয়ে বড় রক্ষক সুন্দরবন আজ নিজেই বিপদে। পড়ুন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে প্রথম আলোর অনুসন্ধান
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন আজ গভীর সংকটে। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে জর্জরিত এই বন, অন্যদিকে ভয়াবহভাবে বেড়েছে মানবসৃষ্ট বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরার ঘটনা। এই অনিয়ন্ত্রিত ও নিষ্ঠুর পদ্ধতির ফলে ধ্বংস হচ্ছে জলজ জীববৈচিত্র্য, বনের প্রাণিসম্পদ এবং গাছপালা—সবকিছুই।
বিষ প্রয়োগের সিন্ডিকেট: তিনটি শক্তিশালী গোষ্ঠীর দাপট
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, অন্তত তিনটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী এই বিষ প্রয়োগে যুক্ত:
মাছ ব্যবসায়ী ‘কোম্পানি মহাজন’রা: জেলেদের প্ররোচনা দেন বিষ প্রয়োগে বেশি মাছ ধরতে।
অসাধু বনরক্ষী: ঘুষের বিনিময়ে বিষ প্রয়োগে সহায়তা করেন।
সাবেক বনদস্যু ও কিছু সাংবাদিক: মাছ শিকারে সহায়তা ও নিরাপত্তা দিয়ে চক্রকে মজবুত করেন।
কীটনাশকের ব্যবহার ও প্রভাব
জেলেরা প্রধানত দুই ধরনের বিষ ব্যবহার করেন—চিংড়ি ও সাদা মাছ ধরার জন্য। সাধারণত ব্যবহৃত হয় ক্লোরপাইরিফস ও সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক, যা পোকা দমন করতে ব্যবহৃত হলেও নদীতে প্রয়োগ করলে অক্সিজেনের ঘাটতি ঘটিয়ে মাছ মেরে ফেলে। এই বিষাক্ত মাছ ও শুঁটকি মানুষ খেলে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি, এমনকি ক্যানসারও হতে পারে, বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অভয়ারণ্যে প্রবেশ নিষিদ্ধ, তবুও চলছে শিকার
প্রায় ৩২০০ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে সুন্দরবনের অভয়ারণ্য ঘোষণা থাকলেও, কোম্পানি মহাজনদের ঘুষ ও বনরক্ষীদের যোগসাজশে প্রতিদিনই সেখানে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার চলছে। এই সিন্ডিকেটের বাইরের কেউ চেষ্টা করলেই তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়।
বনে বিষের প্রভাব: মাছ নেই, পাখি নেই, গাছও আক্রান্ত
প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মাছ ও পাখির সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমে গেছে। এমনকি বিষাক্ত পানি গাছের শিকড়ের মাধ্যমে মাটিতে পৌঁছে ম্যানগ্রোভ গাছপালারও ক্ষতি করছে।
সুনির্দিষ্ট নাম ও চক্রের কার্যক্রম
কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলার অন্তত ২৫–৩০ জন ‘কোম্পানি মহাজনের’ নাম, যাঁরা নিষিদ্ধ এলাকাতেও শিকার চালান। তাদের মধ্যে রয়েছে: জুলফিকার আলী, রেজাউল করিম, আবু মুছা, মোজাফফর, রিয়াছাদ আলীসহ আরও অনেকে। মহাজন আবু মুছা নিজেই স্বীকার করেছেন, বিষ বন্ধ করতে হলে অভয়ারণ্য এলাকার নিয়ন্ত্রণ মহাজনদের মাঝে ভাগ করে দিতে হবে।
বন্ধ মৌসুমেও চলেছে শিকার
জুন-জুলাই-আগস্ট—বন্যপ্রাণীর প্রজনন মৌসুমেও বিষ দিয়ে মাছ ধরার ঘটনা বেড়েছে। বন বিভাগের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বনরক্ষীদের ঘুষ দিয়ে নির্বিঘ্নে বনে প্রবেশ করছে চক্রটি।সুন্দরবনের অস্তিত্ব এখন বাস্তব হুমকিতে। এই বিষ প্রয়োগের চক্র শুধু প্রাকৃতিক সম্পদই ধ্বংস করছে না, বরং দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি করছে। প্রয়োজন:
অবিলম্বে শক্ত হাতে বিষ প্রয়োগ বন্ধে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন,
সুন্দরবনের জন্য আলাদা দুর্নীতি দমন ইউনিট,
সাংবাদিক, বনরক্ষী ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিশেষ তদন্ত ও বিচার,
বিষ প্রয়োগে ধরা মাছের বাজারজাত বন্ধে জাতীয় পর্যায়ে মনিটরিং,
স্থানীয় জনগণকে সচেতন ও বিকল্প জীবিকা নিশ্চিত করা।
**