২১ নভেম্বর ২০২৫, ০১:০৮ পূর্বাহ্ন, ২৯শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি, শুক্রবার, ৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নোটিশ
জরুরী ভিত্তিতে কিছুসংখ্যক জেলা-উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হবে যোগাযোগ- ০১৭১২৫৭৩৯৭৮
সর্বশেষ সংবাদ :
স্ত্রীকে নির্যাতনের মামলায় বরগুনার শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রবিউল হত্যা মামলায় নিরপরাধদের জড়ানোর অভিযোগে বাবুগঞ্জে বিএনপি’র একাংশের সংবাদ সম্মেলন বাবুগঞ্জের ছাত্রদল নেতার খুনিদের গ্রেপ্তার পরবর্তী দৃষ্টান্ত ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ চুয়াডাঙ্গায় ৩ তক্ষকসহ গ্রেফতার ১জন বাবুগঞ্জ এলজিইডি’র এলসিএস কমিউনিটি অর্গানাইজার সানজিদার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার ও হয়রানির অভিযোগ জোটের চাপ নাকি অভ্যন্তরীণ কোন্দল? বরিশাল -৩ আসনে এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পারেনি বিএনপি। ভোটারদের মাঝে ‘ভিআইপি চমক’-এর গুঞ্জন বাবুগঞ্জে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস এর ৫০ বছর পূর্তীতে ঝালকাঠি জেলা জাসাসের উদ্যোগে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাংলাবান্ধায় ভারসাম্যহীন নারী গণধর্ষণেন শিকার চার ধর্ষক আটক বাবুগঞ্জে ছাত্রদল নেতা হত্যাকাণ্ড: ২১ জনের নামে মামলা!
কায়েদে আযমের কষ্টের ধারাপাত! আজকের ক্রাইম-নিউজ

কায়েদে আযমের কষ্টের ধারাপাত! আজকের ক্রাইম-নিউজ

সোহেল সানি

পাকিস্তানের জনক কায়েদ-ই-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তাঁর জীবনই সংগ্রামগাঁথা। সত্যি তা যেন বিচিত্র উপাখ্যান।
কখনো উদারমনস্ক জাতীয়তাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অগ্রদূত। আবার কখনো মনুষ্যহীন নিষ্ঠুর ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক। যদিও মাথা পরিহিত টুপি ‘ জিন্নাহ টুপি’ রূপে খ্যাতিলাভ করলেও তাঁর অভিজাত জীবনধারার অবস্থান করে ধর্মকর্মপালন থেকে দূরে। মদ্যপায়ী হিসাবেও তাঁর বিশেষ পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ছোট্টবেলা থেকেই সান্নিধ্যলাভ করেন বঞ্চণা-প্রবঞ্চণার সঙ্গে। তিনি জন্মসূত্রে মুসলমানীত্বলাভ করলেও পূর্বপুরুষসূত্রে ‘হিন্দুরাজপুত।’ মাতৃভাষা তাঁর গুজরাটি। কিন্তু বাস্তবে তা ত্যাগ করে হয়ে ওঠেন উর্দুভাষী।
বাল্যকালে নাম নিয়েও বিভ্রাট রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সনদে নাম তাঁর মোহাম্মদালী জিন্নাবাই। কালক্রমে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রূপে আত্মপ্রকাশ। আবার স্বাক্ষরিক নাম এম এ জিন্নাহ। নিজের জন্মসাল এবং জন্মতারিখেও রয়েছে বিভ্রান্তি। স্কুল-রেকর্ডে রয়েছে ১৮৭৫ এর ২০ অক্টোবর। উচ্চশিক্ষা সনদে ১৮৭৬ এর ২৫ ডিসেম্বর।
স্বাধীন ভারতবর্ষে বিশ্বাসী শুধু নন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত হিসাবে গণ্য করা হতো। ঘটনাচক্রে স্বাধীন পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটে। তিনি ইতিহাসে অভিষিক্ত হন মহানায়করূপে।
পাকিস্তান হাসিলের পর পরই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুকে চাপাতে চান জাতির ওপর। ফলে গোটা পাকিস্তানেরই সংখ্যগরিষ্ঠ বাংলাভাষীরা রুখে দাঁড়ায়। পূর্ববঙ্গের নাম পাল্টে ‘পূর্বপাকিস্তান’ নামকরণ করা হয়।
চৌধুরী রহমত আলী প্রদেশসমূহের আক্ষরিক একেকটি শব্দ সংযোগে ১৯৩৩-এ আবিস্কার করেন ‘পাকিস্তান’ নামক দেশবাচক শব্দ? যে শব্দার্থে ‘বঙ্গ’ বা ‘বাংলা’ কোন অস্তিত্ব ছিল না।
উর্দু কবি স্যার আল্লামা ইকবাল ১৯৩০-এ মুসলিম লীগ কনভেনশনে যোগ দেন। তিনি ভারতের উত্তর পশ্চিমের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের সমন্বয়ে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন। তাতে বাংলা প্রদেশের কথা ছিল না। ১৯৪০-এ বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯৪০-এ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাতে যে দুটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছিল। তার একটিতে বাংলা প্রদেশকে বুঝানো হয়েছিল।
১৯৪৬ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেশনে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে তা বাতিল করে একটি রাষ্ট্র হিসাবে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ পাস করিয়ে নেন। ভারতবর্ষে ধর্মের নামে স্বাধীন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশের বছর খানেকের মধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু হয়। যে মৃত্যুর মূলে ছিল যক্ষ্মারোগের থাবা। তবে রোগভোগ যতটা না কষ্টের তার ঢেরবেশি কষ্টের ছিল, রাষ্ট্রকর্তৃক তাঁর প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যসুলভ আচরণ। তিনি তখনও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাঁরই ভাবশিষ্য নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান। যক্ষ্মা ধরা পড়লে জিন্নাহ তা গোপন রাখতে অনুরোধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। সবার অলক্ষ্যে চিকিৎসাটা হোক, তাই রাজধানী ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান উচ্চমহলে এটা প্রচার করে দেন।
সেই যুগে একটা প্রবাদ ছিল,’ যার হয় যক্ষ্মা তার নয় রক্ষা’।যক্ষ্মায় আক্রান্ত হবার খবর পাবার পর যেন লিয়াকত আলী খান প্রধানমন্ত্রী ও গভর্নর জেনারেলের উভয় ক্ষমতার অধীশ্বরে পরিণত হন। মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ কফিনে করে রাজধানী করাচীতে নিয়ে আসা হয়। দুই ঘন্টা ধরে বিমান বন্দরে সাধারণ কক্ষের ফ্লোরে ফেলে রাখা হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা স্বাধীন পাকিস্তানের জনকের কফিন। রেডিও টেলিভিশনে মৃত্যুর খবর প্রচারিত হলে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। গণরোষের থেকে মুখ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভাসহ বিমানবন্দরে হাজির হন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। প্রসঙ্গত অচিরেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান জনসভায় ভাষণদানকালে আতঁতায়ীর গুলিতে নিহত হন।
১৯০৫ সালে ভারতীয় কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতা বাল গঙ্গাধর তিলকের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার আইনজীবী হিসাবে ভারতবর্ষের সুশীল সমাজে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি মাত্র উনিশ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয় হিসাবে ‘বার- এট- ল অব ইংল্যান্ড’ সম্মানে ভূষিত হন। এককালীন কংগ্রেস সভাপতি দাদাভাই নওরোজির অনুসারী হিসাবে জিন্নাহ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যোগ দেন।
নাম ও জন্ম বিভ্রাট
স্কুলের রেকর্ডে মোহাম্মদালী জিন্নাবাই ব্রিটিশ শাসিত ভারতের বোম্বাই প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত করাচীতে ওয়াজির ম্যানসনে
জন্ম নেন। পরবর্তীতে নাম বদলে রাখেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। গুজরাটি ধনী বণিক জিন্নাবাই পুনজা ও মিথিবাই এর পুত্র। জিন্নাহর পিতামহ ছিলেন পুনজা মেঘজি। তিনি কাথিওয়ারের গোন্ডল রাজ্যের প্যানলি গ্রামে ‘ভাটিয়া’ বলে পরিচিত ছিলেন। মুলতানের সাইওয়াল গ্রাম হতে তাঁরা প্যানলিতে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পূর্ব পুরুষ পাঞ্জাবের সাইওয়ালের হিন্দুরাজপুত হলেও পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।
জন্মসূত্রে জিন্নাহ মাতৃভাষা গুজরাটি হলেও উর্দু , সিন্ধি, কুচি এবং ইংরেজি ভাষা করায়ত্ত করেন। বোম্বাই গোকলদাস প্রাথমিক বিদ্যালয়, করাচীর ক্রিস্টান মিশনারী সোসাইটি উচ্চ বিদ্যালয় এবং বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন অর্জন করেন এবং লিঙ্কণস্ ইন এ যোগ দেন।
মায়ের চাপে চাচাতো বোন ইমিবাইকে বিয়ে করেন। ১৯১৮ সালে অন্তরঙ্গ বন্ধু অমুসলিম স্যার দিনশো পেট্টির কন্যা ২৪ বছরের ছোট রতনবাই পেট্টি রুক্তিকে বিয়ে করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পেট্টির নতুন নাম হয় মরিয়ম জিন্নাহ। নিজ পরিবার শুধু নয়,পারসীক সোসাইটি ত্যাগ করে তাকে। ১৯১৯ সালে একমাত্র সন্তান দিনার জন্ম হয়। নাম রাখা হয় দিনা জিন্নাহ।
কংগ্রেসে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর উত্থান হলে জিন্নাহ ১৯২০ সালে কংগ্রেস ত্যাগ করেন। ওই সময় দাম্পত্য কলহ তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৯২৭ সালে বিচ্ছেদ হয় তাঁদের মধ্যে।
১৯৩০ সালে বোম্বাইযের যশস্বী পারসি পরিবারের ধর্মচ্যুত কন্যার মৃত্যু হয়। অপরদিকে জিন্নাহর কন্যা দীনা পারস্য বংশোদ্ভূত খ্রীষ্টান নেভিল ওয়াদিয়াকে বিয়ে করেন।
এতে জিন্নাহর সঙ্গে কন্যার সম্পর্ক ছিন্ন হয়। জিন্নাহ ও তাঁর কন্যা দীনাকে দেখভাল করতেন ফাতেমা জিন্নাহ। জিন্নাহর বোন। লন্ডন থেকে বোম্বাই ফিরে এসে আইন ব্যবসায় যোগ দেন এবং Caucus Case মামলা চালনা করে যশস্বী হয়ে ওঠেন জিন্নাহ। ১৮৯৬ সালে কংগ্রেসে যোগ দেন। পরে ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগে। ১৯১৬ সালে সভাপতি হন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের লখনৌ চুক্তির বিনির্মাতা। তিনি সর্ব ভারতীয় হোম রুল লীগ প্রতিষ্ঠাতা।
একটা সময় মত বদলান তিনি। মুসলিম ও হিন্দু সেতুবন্ধনহীন পার্থক্য ও বিপরীতমুখী দুটি পৃথক জাতি। এ কারণে তাঁর নেতৃত্বে দ্বিজাতিতত্ত্বের উত্থান। কিন্তু তা প্রত্যাখান করেন কংগ্রেস নেতা নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ, খান আব্দুল গাফ্ফার খান ও জামায়াত ইসলাম হিন্দ প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী।
জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ৭১ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে মারা যান। তিনি মদ্যপায়ী ছিলেন। ধর্মের নামে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে পবিত্র ইসলাম কায়েমের সংগ্রামেব্রত ছিলেন। কিন্তু সর্বদা টুপি পরিহিত কায়েদ-ই-আযম কখনো নামাজ কায়েম করেছেন এমন তথ্য নেই। ইতিহাসবেত্তরা তাদের গ্রন্থেও এরকম কোন তথ্যচিত্র প্রদর্শন করতে পারেননি, যেখানে দেখা যায় জিন্নাহ নামাজ আদায়রত।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই দাঙ্গা ও সহিংসতায় নিহত হয় দশ লাখ মানুষ এবং তা্ঁর মহাপ্রয়াণের তেইশ বছরের মাথায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটিত করে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত এবং দুই লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পূর্বপাকিস্তান বাংলাদেশ নামে স্বাধীন হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বাঙালীর জাতির পিতা হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালীর মন থেকে মুছে যায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নাম। তিনি শুধু রাষ্ট্রীয়ভাবে পাকিস্তানের ‘বাবা-ই-কউম’ (জাতির পিতা)। অর্থাৎ কায়েদ-ই-আযম (মহান নেতা)। তাঁর সমাধিতে লেখা আছে মাজার- ই কায়েদে আযম।
পিতা জিন্নাহর মৃত্যুর পর মেয়ে দিনা জিন্নাহ নিউইয়র্ক স্থায়ীভাবে নিবাসী হন। পৌত্র নাসলি ওয়াদিয়া মুম্বইয়ের বিখ্যাত শিল্পপতি। মালাবর হিলে অবস্থিত তাঁর বাসভবনটি সংরক্ষণ করার প্রশ্ন এসে ছিল জিন্নাহর জীবদ্দশায়য়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে অনুরোধ করেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। কিন্ত মেয়ে দীনা জিন্নাহ বাসভবনটি তাঁর নামে দাবি করে আপত্তি তোলেন। ফলে অনুরোধেরও অপমৃত্যু ঘটে। ইতিহাস কত নিষ্ঠুর!

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © 2019