২০ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০৪ অপরাহ্ন, ২৮শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি, বৃহস্পতিবার, ৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শনিবার দিল্লিতে দুই দিনের যে জি২০ শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়েছে, তাতে মূলত দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হলো– এর আয়োজক ভারতের নিজেকে পরাশক্তি হিসেবে দেখানোর প্রচেষ্টা। অন্যটি, এই সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর এবার হচ্ছে ২৪তম জি২০ সম্মেলন। বিশ্বের ১৯টি সম্পদশালী দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বয়ে গড়া জি২০-এর এ সম্মেলন হয় খুব সফল হবে, না হয় একেবারে ব্যর্থ।
বিশ্বের একটি অংশ সম্প্রসারিত ব্রিকসের আওতায় একত্র হচ্ছে, যেখানে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে চীন। অন্যদিকে পশ্চিমাদের স্বস্তির জায়গা তাদের বার্ষিক জি৭ সম্মেলন। তাই বহুপক্ষীয়তার নীতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য অবশিষ্ট জি২০-ই শেষ ভরসা। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বৃহস্পতিবার এক বক্তব্যে বিশ্ব ব্যবস্থা টুকরো হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন। তাঁর সংগঠন জাতিসংঘ কতটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত; ইউক্রেন যুদ্ধই তার প্রমাণ।
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ট্রিস্টেন নেইলরের মতে, পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার এ ধরনের বিভাজনের কারণে সম্মেলন থেকে যৌথ বিবৃতি না দেওয়ার ‘সমূহ আশঙ্কা’ রয়েছে। চীন ও রাশিয়া উভয়ই ইউক্রেন বিষয়ে আলোচনা নাকচ করেছে। তবে যেটা করা যায় তা হলো, ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত গত জি২০ সম্মেলনে যেসব বিষয়ে সবাই সম্মত হয়েছিল, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করা। কিন্তু রাশিয়ার অবস্থান হলো, তখন থেকে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ এত তীব্র হয়েছে যে, বালি সম্মেলনকে সেই ভিত্তিরেখা বলা যায় না।
সবার ঐকমত্যে বিবৃতি না দেওয়াটা ভারতের জন্য হতাশার বড় বিষয় হতে পারে। কারণ, ভারত নিজেকে গ্লোবাল সাউথের পক্ষে দায়িত্বশীল হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, জি২০কে কখনও ‘সহযোগিতার পরিবর্তে ক্ষমতার রাজনীতি প্রদর্শনের ক্ষেত্র’ হিসেবে দেখা উচিত হবে না। তিনি দাবি করেন, পূর্ববর্তী কোনো জি২০ আয়োজক দেশ ভারতের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বের সঙ্গে এতটা আলোচনা করেনি। তিনি বলেন, ১২৫টি দেশের মতামত চাওয়া হয়েছে। তাঁর মতে, সবাইকে অন্তর্ভুক্তির প্রতীক হিসেবে ভারত এ ঘোষণা করতে সক্ষম হবে, আফ্রিকান ইউনিয়ন জি২০-এর সদস্যপদ পাবে।
চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা স্পষ্ট। সে জন্য গ্লোবাল সাউথে চীনের প্রভাব থাকায় শি শেষ পর্যন্ত বিবৃতি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করলে যুক্তরাষ্ট্র তার সুযাগ নিতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, এ সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদির সফলতা বিনষ্ট করার দায় তাঁর (শি)। তিনি আরও বলেন, দৃশ্যত মনে হচ্ছে, উন্নয়শীল দেশগুলো বহুপক্ষীয় যে সমস্যা মোকাবিলা করছে সেসব সমস্যা সমাধানের সুযোগ চীন প্রত্যাখ্যান করছে। আমেরিকার অর্থনীতিতে আপেক্ষিক পরিবর্তনের কারণে চীনের অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়টিও তুলে ধরছে যুক্তরাষ্ট্র। সুলিভান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ঋণ সহায়তা, প্রযুক্তি, ব্যাংক সংস্কার এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় একটি প্রস্তাব নিয়ে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্যাকেজে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের জন্য সার্বভৌম একটি ঋণ পুনর্গঠনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সুলিভানের মতে, এর মাধ্যমে ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সুবিধা দেওয়া হবে, যা প্রাথমিকভাবে হবে ২৫ বিলিয়ন ডলার। জ্যাক সুলিভান একই সঙ্গে বলেছেন, অজয় বাঙ্গারের নতুন নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংকেরও ভালো অর্থায়ন কর্মসূচি চীনের বিআরআই তথা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি ইতিবাচক বিকল্প। বিআরআইর ঋণ দেওয়ার পদ্ধতি অনেক বেশি অস্বচ্ছ এবং জবরদস্তিমূলক।
বহুপক্ষীয় এ ব্যাংক সংস্কারের ধারণাটি নেওয়া হয় হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ল্যারি সামারস এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর গ্রোথের সভাপতি এন কে সিংয়ের ভারতে প্রকাশিত একটা বিশালাকৃতির রিপোর্ট থেকে। যুক্তরাষ্ট্র তেমনটা না হলেও চীন ওই রিপোর্টের সুপারিশ সম্পর্কে সতর্ক। বিশেষত যেখানে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অর্থ ব্যবস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ৫০০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করতে পারে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ডিজিটাল রূপান্তরসহ জি২০ সম্মেলনের যেসব থিম গ্রহণ করেছেন; নিঃসন্দেহে সেগুলোর প্রশংসা করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কারণ, সম্মেলনে অনুপস্থিত শির সঙ্গে ওয়াশিংটনের বিরোধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে।
তবে কেউই নিশ্চিত হতে পারছেন না– কেন চীনের প্রেসিডেন্ট জি২০ সম্মেলনে থাকছেন না। কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ইভান ফেইনবাম বলেছেন, তাঁর অনুপস্থিতি চীনের জন্য বেমানান। কারণ সেখানে তাঁর পক্ষের দেশ সৌদি আরবও উপস্থিত থাকছে। ইভানের মতে, ‘হয় তিনি চীনের অর্থনৈতিক মডেল পরিবর্তনের বিষয়ে অভ্যন্তরীণ কাজে ব্যস্ত অথবা তিনি এমন ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করছেন, এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি থাকতে পারেন আবার নাও থাকতে পারেন।’
যদি পরের বিকল্পটা সত্য হয়, তবে ভারত এই সম্মেলনের যে স্লোগান বাছাই করেছে– ‘এক পৃথিবী, একটি পরিবার, একই ভবিষ্যৎ’; তার কোনো কার্যকারিতা থাকল না।
প্যাট্রিক উইনটোর: গার্ডিয়ানের কূটনৈতিক সম্পাদক; গার্ডিয়ান থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক