১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:২১ অপরাহ্ন, ১৫ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, বৃহস্পতিবার, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অনলাইন ডেস্ক::
সম্ভ্রম বাঁচানো ও স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রনা নিয়ে বখাটেদের হুমকি ও যৌণ হয়রাণীর শিকার হয়ে মৃত্যুকে আলীঙ্গন করতে হলো নবম শ্রেণির ছাত্রী হৈমন্তি শুক্লাকে। অথচ উচ্চশিক্ষা গ্রহন করে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন ছিলো তাঁর। সদা হাস্যোজ্জল ও মেধাবী এই শিক্ষার্থীকে নিয়ে বাবা-মায়ের ছিলো অনেক স্বপ্ন। কিন্তু নিজের স¤ভ্রম, পরিবারের সম্মান ও বাবার জীবন রক্ষা করতে সকল স্বপ্নকে ছাইয়ের মতো উঁড়িয়ে দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হলো স্কুল ছাত্রী হৈমন্তি শুক্লাকে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার খেপুপাড়ার সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী হৈমন্তি শুক্লা যৌণ হয়রাণীর লজ্জা সইতে না পেরে গত ২৭ অক্টোবর দুপুরে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামের ভাড়া বাসার নিজ কক্ষে ফ্যানের সাথে ওড়না পেচিয়ে আত্মহত্যা করে। ওইদিন এ ঘটনায় কলাপাড়া থানায় ইউডি মামলা দায়ের হলেও গত ২৯ অক্টোবর শুক্লার পিতা কলাপাড়ার হাজীপুর পল্লী বিদ্যুত সমিতির অভিযোগ কেন্দ্রের ইনচার্জ সুনিল চন্দ্র হাওলাদার পাঁচ বখাটের বিরুদ্ধে কলাপাড়া থানায় মামলা দায়ের করেন।
মামলায় কলাপাড়া পৌর শহরের রহমত পুর এলাকার সেলিম মেকারের ছেলে মো. সুমন (২০), ইউনুচের ছেলে মো. শান্ত (২০), তাঁর চাচা মো. জহির (৪০), মিজানুর রহমানের ছেলে মো. শিশির (২২) ও নাইয়াপট্রি এলাকার জিসানকে (২০) আসামী করা হয়।
পুলিশ পটুয়াখালীর র্যাবের সহায়ত্য়া প্রধান আসামী সুমর ও জহিরকে বুধবার রাতে গ্রেফতার করে। বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে প্রেরণ করা হয় এবং সুমনকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এস আই মো. নুরুজ্জামান।
যে কারনে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতো হলো শুক্লাকে-
পল্লী বিদ্যুত কর্মকর্তা সুনিল চন্দ্র হাওলাদার গত জানুয়ারি মাসে হাজীপুর পোষ্টিং হওয়ার পর কলাপাড়া পৌর শহরের রহমতপুর এলাকায় মোসলেম আলীর বাসায় চার মেয়ে,এক ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে ভাড়ায় ওঠেন। তার সেজ মেয়ে হৈমন্তি শুক্লা খেপুপাড়া সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির মানবিক বিভাগের ছাত্রী ছিলো। পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী শুক্লা স্কুল, বাসা ও প্রাইভেট পড়েই দিনের অধিকাংশ সময় পার করতো।
শুক্লার পিতা সুনিল হাওলাদার জানায়, বখাটে সুমন প্রায়ই তার সহযোগীদের নিয়ে স্কুলে আসা যাওয়ার পথে শুক্লাকে প্রেম নিবেদন করতো এবং কু-প্রস্তাব দিতো। বিষয়টি শুক্লাকে তার মা সবিতা রানীকে জানায়। মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষায় বিষয়টি তিনি সুমনের চাচা জহিরকে জানায়। কিন্তু জহির ব্ষিয়টি গুরুত্ব না দিয়ে তাকে বলে- আজকাল ছেলে-মেয়েরা প্রেম টেম করে থাকে। এতে কিছু হয়না। সুমনের অভিভাবকরা বিষয়টি গুরুত্ব না দেয়ায় সুমন আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং তার বন্ধুদের নিয়ে শুক্লাকে প্রতিনিয়ত হয়রানী করতে থাকে।
তিঁনি বলেন, সুমন ও তার বখাটে বন্ধুদের ক্রমাগত হুমকি ও বখাটেপনায় অতিষ্ট হয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে তিনি রহমতপুরের ভাড়া বাসা ছাড়তে বাধ্য হন। সন্তানদের ভবিষত চিন্তা করে কর্মস্থল হাজীপুরে জনৈক সুমন আলমের বাসায় ভাড়ায় ওঠেন।
হাজীপুর থেকে প্রতিদিন প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শুক্লা স্কুলে আসত। এ স্কুলে আসা যাওয়ার পথে আবার শুরু হয় সুমনের বখাটেপনা। প্রতিনিয়ত রাস্তায় অটো রিকশা থামিয়ে মেয়েকে উত্তক্ত করতো এবং বিয়ের জন্য চাপ দিতো।
গত ২৬ অক্টোবর সকালে প্রতিদিনের মতো শুক্লা অটো রিকশায় করে স্কুলে যাওয়ার পথে সুমন মোটরসাইকেলে করে তার সহযোগীদের নিয়ে রাস্তায় অটো রিকশা থামিয়ে শুক্লাকে প্রেমের প্রস্তাবসহ বিয়ের জন্য চাপ দেয়। তাঁকে বিয়ে না করলে বাবাকে খুন করাসহ শুক্লাকে এসিডে ঝলসে দেয়ার হুমকি দেয়। একপর্যায়ে সুমন শুক্লার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয় এবং টানাহেচড়া শুরু করে। শুক্লাকে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে অটো থেকে নেমে বাসায় চলে আসে। বখাটেদের অব্যাহত হুমকি, মানসিক যন্ত্রনা ও শারীরিক লাঞ্চনা সহ্য করতে না পেরে ২৭ অক্টোবর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে হৈমন্তি শুক্লা।
সহপাঠীদের বক্তব্য-
শুক্লার মৃত্যু সংবাদ শুনে শোকে আচ্ছন্ন তার সহপাঠীরা। দুইদিন আগেও বেঞ্চে পাশাপাশি বসে যাদের সাথে ক্লাশ করতো হঠাৎ তার আত্মহননের বিষয়টি কেউ মেনে নিতে পারছে না। শুক্লার সহপাঠী তানজিলা, সুরাইয়া আক্তার ও তানিয়া জানায়, তিন-চার মাসে শুক্লা তাদের কাছে বখাটে সুমনের কথা বলেছে। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে তাঁকে উত্তক্ত করতো তারা। এতে মাঝে মাঝে ক্লাসে সে চুপ করে থাকতো। অত্যন্ত মেধাবী এ শিক্ষার্থী ছিলো অত্যন্ত মিশুক। সবার সাথে ছিলো শুক্লার হৃদ্রতাপূর্ণ সম্পর্ক। বখাটেদের কারনে তাকে বাসাও বদল করতে হয়েছে। কিন্তু রক্ষা পায়নি যৌণ হয়রাণী থেকে। শুক্লার আত্মহত্যার প্ররোচনায় যারা জড়িত তাদের শাস্তি কামনা করেন তারা।
শিক্ষকদের বক্তব্য-
শুক্লার শ্রেণি শিক্ষক সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, অত্যন্ত মেধাবী ও ভদ্র মেয়ে ছিলো সে। ২৮ অক্টোবর ক্লাশে হাজিরা খাতার রোল কল করার সময় ২১৮ নং রোল নম্বর কল করলে ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই নিশ্চুপ হয়ে যায়। তখন জানতে পারেন শুক্লার মর্মান্তিক মৃত্যুর বিষয়টি। যা খুবই বেদনাদায়ক।
প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রহিম বলেন, ক্লাশ নাইনের মেধাবী এই মেয়ে কেন আত্মহত্যা করবে। তারা শুক্লার মৃত্যুর সঠিক কারন অনুসন্ধানের দাবি জানান প্রশাসনের কাছে।
বর্তমান পরিবারের অবস্থা-
শুক্লার মৃত্যুর পর থেকে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে তার মা সবিতা রানী হাওলাদার। ঘরের মধ্যে বোনের ঝুলন্ত লাশ দেখে বাকরুদ্র তার ভাই-বোনেরা। যে ঘরে ভাই-বোনরা হৈ-হুল্লোর, হাসি-ঠাট্রা ও ঝগড়া করে সময় কাটাতো সেই ঘরে এখন কবরের নিস্তব্দতা। সদাহাস্যোজ্ঝল শুক্লার মৃত্যুর পর থেকে পিতা সুনলি চন্দ্র স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পটুয়াখালীর তার বোনের বাসায় উঠেছেন। এমনকি যে মাটি তার মেয়েকে বাঁচতে দেয়নি সেই কলাপাড়ায় তার অন্তেষ্ট্রিক্রিয়ার করেন নি।
প্রশাসনের বক্তব্য-
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কলাপাড়া থানার এস আই নুরুজ্জামান জানান, শুক্লাকে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হয়েছে। মামলা নং ৩২/২৯-১০-১৯। মামলার পাঁচ আসামীর মধ্যে ইতিমধ্যে দুইজনকে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে এবং প্রধান আসামী সুমনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচদিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
কলাপাড়া থানার ওসি(তদন্ত) মো. আসাদুর রহমান জানান, পুলিশ খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে গিয়ে শুক্লার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পটুয়াখালী প্রেরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর কারন অনুসন্ধানের জন্য ঘটনার পর থেকেই পুলিশ কাজ করছে। মামলার অপর তিন আসামীকেও গেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানান।