১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৬ অপরাহ্ন, ১১ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, শনিবার, ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শরীরে ভীষণ জ্বর নিয়ে গত মঙ্গলবার গৃহকর্ত্রীর ভয়ে চিলেকোঠায় লুকিয়ে ছিল শিশু গৃহকর্মী জান্নাতী (১২)। কিন্তু ঘরের কাজ না করে জান্নাতীর এই বসে থাকা সহ্য করতে পারেননি গৃহকর্ত্রী পিরোজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইদ আহম্মেদের স্ত্রী রোকসানা পারভীন। টেনেহিঁচড়ে ঘরে এনে ছোট্ট জান্নাতীকে নির্দয়ভাবে মারধর করেন তিনি। এ সময় বাসায় ছিলেন সাইদ আহমেদও।
মারধরের কারণে মেয়েটি রান্নাঘরে অজ্ঞান হয়ে পড়লেও মন গলেনি ওই দম্পতির। ওই অবস্থায়ই রান্নাঘরে জান্নাতী পড়ে ছিল প্রায় দুই ঘণ্টা। পরে জ্ঞান না ফেরায় অবস্থা বেগতিক দেখে রাতে নিজেদের গাড়িতে করে জান্নাতীকে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান সাইদ ও রোকসানা। কিন্তু ততক্ষণে ছোট্ট মেয়েটি চলে যায় সব কিছুর ঊর্ধ্বে।
পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে জান্নাতী হত্যা মামলার প্রধান আসামি রোকসানা পারভীন এসব তথ্য দিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার দুপুরে রোকসানা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদপুর থানার ওসি জিজি বিশ্বাস। তিনি বলেন, মামলার অপর আসামি রোকসানার স্বামী সাইদ আহমেদ পলাতক। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
হত্যার আগে জান্নাতী ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমন অভিযোগের বিষয়ে জিজি বিশ্বাস বলেন, জান্নাতীকে তার গৃহকর্ত্রী একাই পিটিয়ে হত্যা করেছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। তবে শিশুটি মৃত্যুর আগে ধর্ষিত হয়েছে এবং এতে তার স্বামীর সম্পৃক্ততা রয়েছে এমন কোনো কথা রোকসানা স্বীকার করেনি। শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়েছে কিনা জানতে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এদিকে মেয়ের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন জান্নাতীর বাবা জানু মোল্লা। গতকাল তিনি বলেন, পেট ভরে তিন বেলা ভাতের আশায় বড়লোকের বাড়িতে আমার প্রাণপাখিটারে (জান্নাতী) কাজে দিছিলাম। তারা পেট ভরে ভাত তো দিলই না উল্টো প্রাণডাই কাইড়া নিল। আমি আমার পাখির (জান্নাতী) হত্যার বিচার চাই।
রোকসানাকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, চাকরি সূত্রে সাইদ আহম্মেদ একসময় বগুড়ায় থাকতেন। জান্নাতীর বাড়ি বগুড়ার গাবতলী। পরিচয়ের সূত্র ধরে চার বছর আগে জান্নাতী সাইদের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে যোগ দেয়। এর পর সাইদের পরিবারের সঙ্গে জান্নাতীও ঢাকায় চলে আসে। সাইদ আহম্মেদ পরিবার নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে স্যার সৈয়দ রোডের ৬/৫/এ নম্বর ৬ তলা ভবনের নিচতলার একটি নিজস্ব ফ্লাটে থাকেন। সাইদ ও রোকসানার সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া একটি ছেলে রয়েছে। গত রোববার থেকে সাইদ ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ওই বাসায় জান্নাতী ছাড়াও আরও দুজন গৃহকর্মী কাজ করেন। ঢাকায় আসার পর প্রায়ই সামান্য বিষয়ে জান্নাতীর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতেন রোকসানা, যার স্পষ্ট ছাপ দেখা গেছে জান্নাতীর নিথর দেহে। লাশের পা থেকে মাথা পর্যন্ত অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন সেই সাক্ষ্য দেয়। এমনকি শিশুটিকে খেতেও দেওয়া হতো না ঠিকমতো।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সেলিম রেজা জানান, জান্নাতীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে ভোঁতা কিছু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার রাতে হাসপাতাল থেকে খবর পেয়ে পুলিশ জান্নাতীর লাশ উদ্ধার করে। আটক করা হয় রোকসানাকে। পরে বুধবার সকালে জান্নাতীর বাবা জানু মোল্লা মোহাম্মদপুর থানায় সাইদ ও রোকসানার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর পর রোকসানাকে গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বাসার অন্য দুই গৃহকর্মীকেও গতকাল জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, মামলা হওয়ার আগে টাকার বিনিময়ে বিষয়টি রফা করতে বহু চেষ্টা করেছিলেন সাইদ আহমেদ। কিন্তু কাজ না হওয়ায় পরে গা-ঢাকা দেন। গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে জান্নাতীর মরদেহ গ্রামের বাড়ি নিয়ে যান তার স্বজনরা।