০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৮ অপরাহ্ন, ৪ঠা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি, বৃহস্পতিবার, ২২শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
স্টাফ রিপোর্টার কায়কোবাদ তুফান (৩৬)। তিনি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক নেতা। এবং তৎকালীন প্রভাবশালী পৌর চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মো. সুলতান আহম্মেদের ছেলে। কিন্তু ক্ষমতার ভারসাম্য ধরে রাখতে পারেননি তিনি। বরং বেসমাল কর্মকান্ড এবং আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছেন নানামুখী বিতর্কে। ঘটনাবলীতে কায়কোবাদ তুফানের বিরুদ্ধে একাধিকও রয়েছে। এরমধ্যে আলোচিত দুটি মামলা ২ যুবলীগ নেতাকে হত্যাচেষ্টা। কিন্তু পরেও তার লাগাম টেনে ধরতে পারেনি বা যায়নি। সর্বশেষ তিনি হত্যাচেষ্টা মামলার বাদী যুবলীগ নেতাকে আদালত চত্বরেই ফের খুনের হুমকি দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছেন।
অবশ্য এই হুমকির বিষয়টি ইতিমধ্যে পুলিশ সত্যতা পেয়ে আদালতকে অবহিত করলে বিচারক তাকে গ্রেপ্তারে নির্দেশ নিয়েছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট নলছিটি থানা পুলিশ তুফানকে গ্রেপ্তারে অগ্রসর হচ্ছে না। বরং তিনি এলাকায় অবস্থান করলেও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তুফান পলাতক রয়েছেন।
পুলিশের এমন প্রতিবেদন দেখে সর্বশেষ তার সন্ধান চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ দিয়েছেন ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে- কায়কোবাদ তুফান নলছিটি উপজেলা শহরেই অবস্থান করছেন। এমনকি তিনি পুলিশ প্রশাসনের আশেপাশেও থাকছেন। তাদের সঙ্গে চা-চক্রেও মিলিত হচ্ছেন। পুলিশের এমন ভুমিকা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ ঘটনায় মামলার বাদী সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে- গত ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর নলছিটি পৌরসভা নির্বাচনের দিন উপজেলার অনুরাগ গ্রামে উপজেলা যুবলীগের দুই নেতাকে হত্যা চেষ্টার ঘটনা ঘটে। ওই হত্যাচেষ্টার ঘটনায় নলছিটি থানায় দায়ের করা পৃথক দুই মামলার আসামি তুফান। মামলা দুটি বর্তমানে ঝালকাঠির আদালতে চলমান রয়েছে। একটি মামলার বাদী ইকবাল হোসেনকে আদালতের গেটের সামনে প্রকাশ্যে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয় তুফান ও তার সহযোগীরা। এমনকি মামলা তুলে না নিলে তাকে পঙ্গু করে দিবে বলেও ঘোষণা দেয়। এ ঘটনায় ইকবাল হোসেন ঝালকাঠি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। আদালতের অনুমতি নিয়ে জিডি তদন্ত করে গত বছর ১০ অক্টোবর কায়কোবাদ তুফানের বিরুদ্ধে ঝালকাঠি থানার নন জিআর-৯১/১৮ মামলায় প্রতিবেদন (প্রসিকিউশন) দেন এএসআই হাসানুজ্জামান। এর প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক। এরপরও আদালতে হাজির না হলে তার মালামাল ক্রোকের নির্দেশ দেওয়া হয়।
নলছিটি থানার সহকারি উপ-পরিদর্শক (এএসআই) অনিক সিদ্দিকী মালামাল ক্রোক না করে এবং আসামিকে পলাতক দেখিয়ে গত ৩০ জুলাই আদালতে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। পুলিশের এমন প্রতিবেদন দেখে সর্বশেষ তার সন্ধান চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ দিয়েছেন আদালতে বিচারক এএইচএম ইমরানুর রহমান।
উল্লেখ করা যেতে পারে- বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য ইলেন ভুট্টোর স্নেহধন্য ছাত্রদল নেতা কায়কোবাদ তুফান বিএনপি-জামাত জোট আমলে উপজেলা বাস্তুহারা লীগের বর্তমান সভাপতি মিন্টু হাওলাদারসহ অনেক আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে-পিটিয়ে জখম করেন। তৎসময়ে সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের পরে তিনি জেল খাটেন বেশ কিছুদিন। এরপর নান্দিকাঠি এলাকায় কশাই শহীদের বাড়ি গিয়ে চাঁদা দাবি করলে এলাকার মহিলারা তার জামা-প্যান্ট খুলে ল্যাংটা করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। চাঁদাবাজির ঘটনায় তার বিরুদ্ধে নলছিটি থানায় একটি মামলাও হয়। গত ২০১৬ সালের ২৮ জুন তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো. ইউনুস লস্করের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে কায়কোবাদ তুফান আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। একই বছর ১৫ নভেম্বর জেএসসি পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহের অভিযোগে তুফানকে আটক করে পুলিশ। আটকের পর পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে গেলে সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে যান তিনি। এরপর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে পুলিশ তাকে ফের আটক করে।
পরবর্তীতে তাকে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহ মো. কামরুল হুদার ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাকে দুই মাসের কারাদন্ড দেয়। বেশ কিছুদিন জেল খাটার পর তুফান জামিনে মুক্তি পায়। এ বছরের (২০১৯) শুরুর দিকে নলছিটি শহরের চৌমাথার হার্ডওয়ার দোকানদার মো. রুস্তুম আলীর কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা নেন তুফান। এ ঘটনায় ইউএনও, মেয়র ও নলছিটি থানার ওসির কাছে কান্নাকাটি অভিযোগ করেন রুস্তুম। সর্বশেষ উপজেলার পুরান বাজার এলাকায় এক বেকারি মালিকের কাছে চাঁদা দাবি এবং ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনায় ঝালকাঠির আদালতে মামলা দায়ের করেছেন এক ভুক্তভোগী। মামলাটি আমলে নিয়ে বিচারক নলছিটি থানা পুলিশকে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
অথচ এই অপরাধীকে গ্রেপ্তারে নলছিটি পুলিশের রয়েছে গড়িমসি। যে বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে বলে মনে করছেন না খোদ আইনজীবীরাও।
ঝালকাঠি জেলা আইনজীবী সমিতির একাধিক আইনজীবীর ভাষ্য হচ্ছে- পরোয়ানা জারির পরেও আসামিকে গ্রেফতার না করা আদালতকে অবমানা করার মতো গুরুতর অপরাধ। এই অপরাধে আদালত সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের বিরুদ্ধে যেকোন সময় পদক্ষেপ নিতে পারেন। পাশাপাশি এই অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যেকোন সময় মামলা নিতে পারে।
তবে নলছিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাখাওয়াত হোসেন এবার বলছেন- অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে নেমেছে।’